বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব

আগস্ট 05, 2019

বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব

বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিন থেকে গরম বাষ্প উঠতে দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন আবার ভয়ও পেয়েছেন। এর কারণ আমরা বাইক গরম অবস্থাতেই অনেক সময় ওয়াশ করানোর জন্য বাইক ওয়াশ সার্ভিসে নিয়ে যাই। আর তখনই এমনটা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের আজকের আলোচনা বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব নিয়ে।

তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাব :
উত্তপ্ত ইঞ্জিনে পানি ঢালা বা ব্যবহার করা আসলেই একটি ক্ষতিকর অভ্যাস। কিন্তু আমরা না জেনে না শুনে এই কাজই করে আসছি বহুদিন ধরে। উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানি ঢাকলে তাপমাত্রার যে পরিবর্তন ঘটে তা পদার্থে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলবে একটু জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

পদার্থের উপর তাপের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। যখন কোন পদার্থের তাপমাত্রা বাড়ানো হয় তখন পদার্থের মধ্যকার অনুগুলো তার স্থানে কাঁপতে থাকে। তাপমাত্রা আরো বাড়ানো হলে তাপের অনুপাতে অনুগুলোর কম্পন আরো বেড়ে যায়। আর একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পর অনুগুলোর কম্পন বেড়ে গিয়ে নিজের স্থান থেকে সরে যায়। আর এই অবস্থার প্রেক্ষিতে পদার্থ কঠিন অবস্থা থেকে তরল, আর তরল অবস্থা থেকে বায়বীয় পদার্থে রুপ নেয়; আর তাদের বৈশিষ্ট্যে আমূল পরিবর্তন আসে। আর এই প্রক্রিয়ায় পদার্থের আকার আকৃতিতেও নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।

আবার অপরদিকে যখন পদার্থের তাপমাত্রা কমানো হয় তখন উল্টো প্রক্রিয়া ঘটে। সেক্ষেত্রে পদার্থের অণুগুলো ঘন সন্নিবেশিত হয়ে পড়ে। যার ফলে তাদের মধ্যের যে ফাঁক গুলো ছিলো সেগুলো একেবারেই কমে যায়। আর সাধারণত তাপ হ্রাসের শেষ অবস্থায় লক্ষ্য করা যায় অনুগুলো তাদের নিজস্ব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। ফলে পদার্থ তার নিজস্ব শক্তি, নমনীয়তা হারিয়ে এক ভঙ্গুর প্রকৃতি ধারণ করতে বাধ্য হয়।

কঠিন পদার্থে দ্রুত তাপ পরিবর্তন :
সাধারন বিজ্ঞানের আলোচনার পর প্রশ্ন এসে যায় যদি খুব দ্রুত কোন পদার্থের তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটানো হয় তখন আসলে কি ঘটে? মূলত: এই দ্রুত তাপমাত্রার পরিবর্তনে তরল ও বায়বীয় পদার্থ সমানুপাতিকহারে সাড়া দেয়। এক্ষেত্রে তাদের অনুগুলো দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে, পদার্থের ঘনত্ব কমে যায় আর পরিসরে বৃদ্ধি পায় এবং শেষতক তাদের নির্দিষ্ট আকৃতি লোপ পায় আর বাষ্পীভুত হয়। তবে বায়বীয় ও তরল পদার্থের প্রমিত তাপমাত্রা নিশ্চিত করলে তারা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। তবে সাধারনত কঠিন পদার্থ বিশেষকরে ধাতব পদার্থের উপর তাৎক্ষনিক তাপমাত্রার পরিবর্তন ধীর আর যথেষ্ট নেতিবাচক। আর প্রভাব আরো খারাপ হয় যখন ধাতব পদার্থের উপর আংশিকভাবে তাৎক্ষনিক তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটানো হয়। কঠিন পদার্থের তাৎক্ষনিক তাপমাত্রার বৃদ্ধিতে অনুগুলো সেই অনুপাতে যথেষ্ট দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনা। আর তাপমাত্রা আকষ্মিক হ্রাসেও ছড়িয়ে কাঁপতে থাকা অনুগুলো সেই অনুপাতে অনেকাংশেই দ্রুত স্বস্থানে ফিরে আসতে পারেনা। মূলত এধরনের অবস্থার প্রেক্ষিতেই কঠিন পদার্থ তার প্রমিত তাপমাত্রার কিছু গুনাবলী হারিয়ে ফেলে। এর ফলশ্রুতিতে পদার্থ তার স্বাভাবিক শক্তি, নমনীয়তা হারিয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। সুতরাং এখানে আকষ্মিক তাপমাত্রা পরিবর্তনের বিপজ্জনক মাত্রাটা সহজেই অনুমেয়। আর বিজ্ঞানের ভাষায় একেই বলা হয় থার্মাল শক, যেটা ধাতব পদার্থে বিশেষ প্রভাব ফেলে।

এ পর্যন্ত আমাদের আলোচনায় উঠে এলে তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে কি হতে পারে এবং কঠিন পদার্থে দ্রুত তাপ পরিবর্তন হলে কি হয়ে থাকে এই দুটো ব্যাপার। কিন্তু আমাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা। কিন্তু এই বিষয়টার সাথে আমাদের আলোচনায় প্রথম দুটি ব্যাপার জড়িয়ে আছে বিধায় আমরা এমন আলোচনা করেছি। তাহলে চলুন এবারের আলোচনায় জানা যাক বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব কেমন।

বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব :
একটি বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির ঢেলে দিলে আসলে কি ঘটতে পারে? একটি গরম ইঞ্জিনে পানি ঢেলে দিলে বাহ্যত আপনারা দেখবেন পানি দ্রুত বাষ্পিভুত হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে পানি খুব দ্রুত ইঞ্জিন ক্রাঙ্ককেস এর উপরিভাগ থেকে তাপ শোষন করে বাস্পীভুত হয় ।কিন্তু বিপজ্জনক বিষয় হলো ক্রাঙ্ককেসের ভেতরের তলে উচ্চ তাপমাত্রাই থেকে যায়। ফলে একই ক্রাঙ্ককেসের একই স্থানে ভিন্ন তলে তাপমাত্রার প্রচন্ড বৈষম্য সৃষ্টি হয়। আর আরো বিপদজনক বিষয় হলো ঢেলে দেয়া পানি পুরো ক্রাঙ্ককেস থেকে তাপমাত্রা শোষন না করে কেবল ঢেলে দেয়া অংশ হতে তাপ শোষন করে। সুতরাং এক্ষেত্রেও তাপমাত্রার বৈষম্য প্রকট হয় আর ক্রাঙ্ককেস প্রচন্ড থার্মাল শকের শিকার হয়। এই অবস্থায় অনেকেই হয়তো বলতে পারেন যে তারা বহুবার এমন করেছেন তবে আজ পর্যন্ত তাদের বাইকের ইঞ্জিনে কিছু হয়নি তো! তবে সচেতন হবার এমন প্রশ্নই বা আসছে কেন? উত্তরে বলতে হয়, তারা অনেকটাই ভাগ্যবান যে বাইকের ইঞ্জিনের ধাতব উপাদান এমন শক্ সহ্য করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ও সহনশীল। তবে এও সত্য যে এই সব অবিবেচনা প্রসূত বাজে অভ্যাসের ক্ষতিকর ফল সুদুরপ্রসারী। তবে চলুন দেখে নেয়া যাক উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব কেমন হতে পারে।

উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানি পড়লে কি ঘটতে পারে :

* ইঞ্জিন ক্রাঙ্ককেসে আংশিকভাবে সুক্ষ ছিড় দেখা দিতে পারে যেটা পরে আরো ছড়িয়ে যেতে পারে।

* ইঞ্জিনের কালার কোটিং, ফিনিশিং নষ্ট হবার পেছনে উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব অনেক বেশি থাকে।

* উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলে ক্রমে ইঞ্জিন ক্রাঙ্ককেস এর স্বাভাবিক শক্তি ও নমনীয়তা হারায় আর ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

* উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব এ ইঞ্জিনের খাঁজ, বোল্ট ও অন্যান্য অংশে মরিচা, ক্ষয় ও মলিনতা দেখা দেয়।

* তাপ শোষনের ফলে বের হওয়া গরম বাষ্প বাইকের সিডিআই, ইসিইউ ও অন্যান্য ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রাংশের সরাসরি ক্ষতি করে।

* এটা স্পার্ক প্লাগের আয়ু কমিয়ে দেয় ও স্পার্ক প্লাগের সিরামিক জ্যাকেট ভঙ্গুর করে তোলে।

* তাপমাত্রার ব্যাপক বৈষম্য বা পরিবর্তনের ফলে মোটরসেইকেলের কুলিং সিষ্টেমে লিকেজ দেখা দেয়।

* এই অভ্যাসের ফলে ইঞ্জিন গ্যাসকেট নষ্ট হয়ে যেতে পারে আর তেল লিক হতে পারে।

বৃষ্টি এলে করণীয় :
বাইক চলা অবস্থায় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলেও তা গড়িয়ে ইঞ্জিনের উত্তপ্ত অংশে যেতে খানিকটা সময় পায়। আর এক্ষেত্রেও ক্রাঙ্ককেস বাতাসের তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য কিছুটা হলেও সময় পায়। তবে প্রবল বৃষ্টিতে গরম ইঞ্জিন নিয়ে বাইক চালানোর যে খারাপ প্রভাব রয়েছে তা অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই। তবে কেউ কি তা কেয়ার করে? সত্যি বলতে কি আমি নিজে অন্তত কেয়ার করি না। কারন বৃষ্টিতে মোটরসাইকেল চালানো আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের একটি বিষয়!

আমাদের উচিত বাইকের সকল বিষয়ে যত্নশীল হওয়া এবং সঠিক নিয়ম মেনে বাইক চালানো। বাইকের উত্তপ্ত ইঞ্জিনে ঠান্ডা পানির প্রভাব সম্পর্কে অনেকেই অবগত ছিলেন না। কিন্তু এই আলোচনায় সব উঠে এসেছে। একটু সচেতন হলেই বাইক থেকে ভালো সার্ভিস পাওয়া যাবে আবার বাইকের ইঞ্জিনও ভালো থাকবে। কাজেই নিজের মনগড়া নিয়মে না গিয়ে সঠিক নিয়ম মেনে চলুন তবেই বাইক আপনাকে সর্বোচ্চ ভালো সার্ভিস দিয়ে যাবে লম্বা সময়।