ব্রেকিং পিরিয়ড কি ?

জুলাই 09, 2019

ব্রেকিং পিরিয়ড কি ?

আমাদের দেশের বেশিরভাগ তরুণের কাছে বাইক বা মোটর সাইকেল একটা স্বপ্নের নাম। একটা বয়সের তরুণেরা যেমন স্বপ্ন দেখে একজন সুন্দরী সঙ্গীর তেমনি স্বপ্ন দেখে বাইকের। নিজের প্রিয় বাইকে প্রিয়জনকে নিয়ে ভনাত করে ছুটতে ভালোবাসে এই প্রজন্ম। কিন্তু বাইকের মালিক হয়ে উঠে যেমন সহজ ঠিক ততোটুক কঠিন বাইকটাকে নিজের প্রিয় মানুষটার মতই যত্ন করা। স্বপ্নের বাইক হাতে আসলে তখন নতুন বাইকের রোলস মেনে চলার ব্যাপারটা বাইক পাওয়ার আনন্দে মাথা থেকে বের হয়ে যায়। যেমন ব্রেইক ইন না মেনে ইচ্ছে মত চালাতে থাকলে প্রিয়জনের মুখে হাসি ফুটবে ঠিকই কিন্তু এই প্রিয় বাইকটা আর বাইক থাকবে না। বারোটা বেজে যাবে ইঞ্জিনের। আচ্ছা নিয়ম জানার আগে তবে জেনে নেওয়া যাক ব্রেক – ইন – পিরিয়ডটা আসলে কি।

বেশ কিছু ধাতব যন্ত্রাংশ দিয়ে মোটর সাইকেল বা বাইকের ইঞ্জিন তৈরি হয়। আরো সহজ ভাষায় বললে এই ধাতব যন্ত্রাংশগুলো ছাড়া ইঞ্জিন তৈরি সম্ভব হয় না। চেষ্টা করা হয় যথেষ্ট নিখুঁত ভাবে এগুলো স্থাপনের কিন্তু তারপরও কিনারার দিকটায় অমসৃণতা থেকে যেতে পারে। আর বিশেষ করে পিষ্টনের রিং গুলো সঠিকভাবে মসৃণ হওয়া বাঞ্চনীয়। ইঞ্জিনে ব্যবহৃত এই ধাতব যন্ত্রাংশ গুলো সঠিকভাবে মৃসন হওয়ার সময় দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ নিয়মে নতুন মোটর সাইকেল বা বাইক চালাতে হয়, মূলত এই নিয়মটাকেই ব্রেক – ইন – পিরিয়ড বলা হয়।

মোটর বাইকের এই ব্রেক – ইন – পিরিয়ড দুই ভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। প্রথমটা হলো মোটর বাইকের ম্যানুয়েলের নিয়ম অনুসারে আর পরেরটা একদম সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে। এই ব্রেক – ইন – পিরিয়ড নিয়ে অনেক বইও রচনা করা হয়েছে। কিন্তু এসব বই আর নির্দেশিকা কয়জনই বা ফলো করে বা করতে চায়। সবাই তো বাইকের মালিক হওয়াতেই সীমাবদ্ধ। তারপর ইচ্ছে মত চালিয়ে ইঞ্জিনের বারোটা বাজিয়ে তবেই ইঞ্জিনিয়ারের কাছে ছুটে যাওয়া। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে যায়। অনেকটাই সময়মত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার আগেই রোগীর অক্কা পাওয়ার ব্যাপারটা মত। সময় নিয়ে বই কিংবা নির্দেশিকা পড়তে না পারলে ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বাইকের বিক্রেতার কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত। আর ইঞ্জিনিয়ার আর বিক্রেতারা ঠিকই সব বলে দেন কিন্তু কে শুনে কার কথা? মাথায় যে কেবল প্রিয় মানুষকে নিয়েে বাইকে উড়ে যাবার চিন্তা।

এই ব্রেক – ইন – পিরিয়ড মোটর বাইকের প্রথম এক হাজার কিলো মিটারের জন্য হয়ে থাকে। তবে বাইকের ইঞ্জিনিয়ারদের কথা মত এই সময় যত বেশি দীর্ঘ করা যাবে ততোটাই ভালো হবে। তারা আরো বলেন বেশি সময় নিয়ে ব্রেক – ইন – পিরিয়ড মেনে চললে ইঞ্জিনের ধাতব যন্ত্রাংশগুলো আরো অধিকতর মসৃণ হয়। এই পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে মোটর বাইকের জন্য বেশ কিছু নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, একটা নির্ধারিত গতি ব্যবহার করতে হয়। যেমন, ঘন্টায় গতি ৪০-৫০/ কিমি এর বেশি হওয়া যাবে না। ৪০ হলেই মূলত ভালো হয়। এবং সহযাত্রী নেওয়া যাবে না। যেটাকে পিলিয়ন বলা হয়ে থাকে। একইসাথে লং ড্রাইভ বা দূরের পথ ভ্রমণ করা যাবে না। আর এর সাথে নিয়ম করে ইঞ্জিন ওয়েল পরিবর্তন করতে হয়। ২০০ থেকে ৩০০ কিলো মিটারের মধ্যে একবার আর ১০০০ কিলো মিটারের পরে আরেকটা ইঞ্জিন ওয়েল পরিবর্তন করা বাধ্যতামূ্লক। এই সময়টা RPM ৬৫০০ এর নীচে রাখতে হবে। হয়তো আজকাল এসব নিয়ম পুরোপুরিভাবে মেনে বাইক চালানো সম্ভব হয়ে উঠে না। কিন্তু যতই কষ্টকর হোক না কেন এটা মেনে চলতেই হবে। ব্রেক – ইন – পিরিয়ড ব্যাপারটা ছোট্ট বাচ্চাদের জন্মের পরে বেশ কিছু নিয়মের মধ্যে দিয়ে যত্ন করার মতই।

ব্রেক – ইন – পিরিয়ড চলাকালীন আরো কিছু বিশেষ নিয়ম আছে। যেমন, সর্বোচ্চ থ্রটল ব্যবহার করা যাবে না। একটানা একই গতিতে মোটর বাইক চালানো যাবে না। হঠাৎ করে স্পীড বাড়ানো আবার হঠাৎ করেই স্পিড একদম কমিয়ে ব্রেক করা যাবে না। প্রথম ১০০০ কিলো মিটার মোটর বাইকের সর্বোচ্চ স্পীডের অর্ধেক বা ৩/৪ ভাগ ব্যবহার করা যায়। তবে এর বেশি কোনভাবেই না। সিনথেটিক ইঞ্জিন ওয়েলের পরিবর্তে মিনারেল ইঞ্জিন ব্যবহার করতে হবে। মোটর বাইক চালানোর পূর্বে কিছুক্ষণ ইঞ্জিন গরম করে নিতে হয়। এর ফলে ইঞ্জিন ওয়েল সর্বত্র পৌঁছে যাবার সুযোগ পায়। ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হলে ইঞ্জিনিয়ারকে দেখাতে হবে।

এবার জানা যাক ব্রেক – ইন – পিরিয়ডের সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। শুরুতেই মোটর বাইকে চালু করে মিনিট পাঁচেক রাখতে হবে। তারপর সমথল কিংবা ফাঁকা রাস্তায় একই বেগে এক টানা কমপক্ষে ১০ কিলো মিটারের মত চালাতে হয়। তারপরে ৫ মিনিটের একটি ছোট্ট বিরতি। তারপরে আবার একই গতিতে ১০ কিলো মিটার চালাতে হবে তারপরে আবার বিরতি দিতে হবে। তবে এই সময়ে ব্রেক করা যাবে না। গতি কমানোর প্রয়োজনে থ্রটল কমিয়ে গতি কমাতে হবে। সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতেও রয়েছে আরো একটি ধাপ। অসমতল বা পাহাড়ী রাস্তায় বেশি গতিতে চালাতে হবে। মাঝেমাঝে গতি একটু কমিয়ে আবার বাড়িয়ে নিতে হয়। এভাবে চালাতে হবে ৮০ থেকে ১০০ কিলো মিটার। তারপর ইঞ্জিন ওয়েল পরিবর্তন করে নিতে হবে।

বাজারে এখন অনেক সুপার বাইক পাওয়া যায়। এগুলো আসলে রেডি টু রান অবস্থায় থাকে। একই রকম আরেক ধরনের বাইক থাকে যেগুলোও সুপার বাইকের মত ব্রেক – ইন – পরিয়ডের প্রয়োজন নেই। এগুলো হচ্ছে স্পোর্টস বাইক। আসলে সব ধরনের টেস্ট রান সম্পন্ন করে রাখা হয়। যার ফলে বাইক তৈরি হয়ে থাকে সব দিক থেকেই চলার জন্য। তবে মনে রাখতে হবে এটা সাধারণ আর স্বল্পমূল্যের মোটর বাইকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। তবে বিভিন্ন কোম্পানী এখন টেস্ট রান সম্পন্ন করেই শো রুমে তুলে রাখে। যার জন্য আর ব্রেক – ইন – পরিয়ডের কোন প্রয়োজন পড়ে না।

এছাড়াও ব্রেক – ইন – পিরিয়ডের সময় অকটেন ব্যবহার করতে হয়। এর কারণ হিসেবে বড় বড় মোটর বাইক ইঞ্জিনিয়াররা বলেন এই সময়টায় জ্বালানি হিসেবে অকটেনের বিকল্প নেই। কারণ ব্রেক – ইন – পিরিয়ডের সময় স্পিড লিমিট, আরপিএম থাকে কম এবং বেশিক্ষণ এক টানা চালানো যায় না। আর ইঞ্জিনও গরম হওয়ার সুযোগ একদমই পায় না। আর যদি এই সময়টা অকটেন ব্যবহার করা হয় তবে ইঞ্জিত পর্যায় গরম হয়। একইসাথে ধাতব যন্ত্রাংশ গুলোও কর্মক্ষম হয়ে উঠে যথাযথভাবে। আর নতুন বাইকে অকটেন ২০০ কিলো মিটার পর্যন্ত ব্যবহার করা সম্ভব।

একটি মোটর বাইক কিনে নেওয়াই সব না। কিনে সঠিকভাবে পরিচালনা করাটাই আসল। না হলে মোটর বাইক থেকে ভালো সার্ভিস আশা করাটা বোকামী। আজকাল আমাদের সমাজে দেখা যায় ব্রেক- ইন – পিরিয়ড মেনে চলানোটা অসম্ভব। অসম্ভব এ জন্যই হয়েছে কারণ অনেকে আলসামো করে এসব মানতে চায় না আবার অনেকে স্বপ্নের বাইক নিয়েই গতির খেলা শুরু করে দেয়। স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হলেই সব শেষ না। স্বপ্নটাকে বাস্তবে পরিণত হওয়ার পরেও লালন পালনের বিকল্প নেই। মোটর বাইকের ব্রেক – ইন – পিরিয়ড প্রক্রিয়াটাও ঠিক তেমন। সহযাত্রী নিয়ে শুরুর দিক থেকেই চলা আর গতির মেলায় মেতে উঠলে বাইকের দীর্ঘস্থায়ীত্ব কমে যাবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর এই প্রক্রিয়ার জন্য ম্যানুয়াল পদ্ধতিটাই বেঁচে নেওয়া উচিত।